আল্লাহ তায়ালা বিবাহকে নারী-পুরুষের জন্য ফরজ করে দিয়ে, নারীর অর্থনৈতিক অধিকার সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে বিবাহ বন্ধনের সময় স্ত্রীর দেনমোহর আদায় করা পুরুষের জন্য ফরজ করে দিয়েছেন এবং বিবাহের সময়ই দেনমোহর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।
বিবাহের সময় প্রাপ্য পুরো দেনমোহর আদায় করতে পুরুষ অপারগ হলে, দেনমোহরের একটা নির্দিষ্ট অংশ আদায় না করা পর্যন্ত বিবাহ বৈধ হবে না।
আইন অনুযায়ী দেনমোহর হলো বিয়ের একটি শর্ত এবং স্ত্রীর একটি আইনগত অধিকার। এ অধিকারবলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে কিছু পরিমাণ অর্থ বা সম্পত্তি পাওয়ার অধিকারী হয়। দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণস্বরূপ এবং অবশ্যই পরিশোধযোগ্য।
বাংলাদেশের আইনে দেনমোহর নিয়ে যুগোপযোগী কোনো আইন নেই। এমনকি বিবাহ-সম্পর্কিত যেসব আইন রয়েছে তাও অনেক পুরনো।
বাংলাদেশে ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন, ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইন প্রভৃতি আইনের সমন্বিত নিয়ম-ধারার অধীনে মুসলমান সমাজে আইনি বিয়ে ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সম্পাদিত হয়। অবশ্য এ যাবতীয় আইনই ইসলামী শরিয়তের অন্তর্বর্তী এমনটা বলা যায় না। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনেই দেনমোহরের বিষয়টি উল্লেখ আছে।
১৯৮৫ সালে এর কিছু সংশোধন করা হয়। এছাড়া অদ্যাবধি কোনো আইন সংশোধন বা পরিবর্তন হয়নি। দেনমোহর স্বামীর ঋণ, যা স্বামী তার স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য। মাহমুদা খাতুন বনাম আবু সাইদ (২১ ডি.এল.আর) মামলায় মহামান্য বিচারপতি কর্তৃক সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, 'সহবাসের আগে এবং পরে স্ত্রী স্বামীর অধিকারে অর্থাৎ সহবাসে যেতে স্ত্রী অস্বীকার করতে পারেন।' এ অজুহাতে স্বামী স্ত্রী থেকে দূরে অবস্থান করলে তা পরিশোধে বাধ্য। {(১১ ডি.এল.আর) (ডবলু পি)} লাহোর ১২৪। স্বামী এ জাতীয় মোহরানা পরিশোধ ব্যতীত দাম্পত্য অধিকারের ডিক্রি পেতে পারে না। যে কোনো বিষয় সম্পত্তি মোহরানার জন্য ধার্য করা যায় না। এটি হতে পারে নগদ অর্থ, কোনো বীমা পলিসি বা অন্য কোনো দ্রব্য সামগ্রী। তবে কোনো হারাম বস্তু হতে পারবে না। স্বামীর দখলে নেই এমন কোনো সম্পত্তি থেকে মোহরানা হতে পারে না। ভবিষ্যৎ কোনো বিষয়ও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে না।
১৯৬১ সালের পারিবারিক আইনের ১০ ধারা অনুযায়ী দেনমোহর দেয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে কাবিনে বিস্তারিত উল্লেখ না থাকলেও স্ত্রী চাওয়ামাত্র সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করতে হবে। সালিশি পরিষদের আদেশবলে এটি কার্যকর হলে স্ত্রীর তা পাওনা হয়ে যায়। পরিশোধ না করলে এক মাস কারাদ- বা ২০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দ- হতে পারে। দেনমোহরের মামলা ও তামাদি আইন ক. স্ত্রী তার দেনমোহরের টাকা না পেলে তিনি এবং তার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারীরা এর জন্য মামলা দায়ের করতে পারে। খ. আশু দেনমোহর স্ত্রী চাওয়ামাত্র স্বামী দিতে বাধ্য। স্বামী দিতে অস্বীকার করলে বা না দিলে সেদিন থেকে তিন বছরের মধ্যে স্ত্রীকে মামলা দায়ের করতে হবে। বিলম্বিত দেনমোহর আদায়ের সময়সীমা হলো মৃত্যু অথবা তালাকের ফলে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটলে ওই তারিখ থেকে তিন বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। তা না হলে মামলা তামাদি হয়ে যাবে।
১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের ৫নং ধারায় পারিবারিক আদালতকে দেনমোহরের মোকদ্দমা বিচারের নিরঙ্কুশ এখতিয়ার প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে স্ত্রী যে আদালতের স্থানীয় এখতিয়ারের মধ্যে বসবাস করছে সেখানে অথবা যে আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে মামলার কারণ উদ্ভব হয়েছে সেখানে অথবা পক্ষদ্বয় যেখানে একত্রে (শেষবার) বসবাস করেছে সেখানে স্ত্রী মামলা দায়ের করতে পারেন। পারিবারিক আদালতে মাত্র ৬০ টাকা ফি প্রদানের মাধ্যমে বিচার প্রার্থনা করা যায়।
১৯৬১ সালের পারিবারিক আইনে যা ছিল মাত্র ২৫ টাকা। এ আদালত অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে বিচার মীমাংসা করে থাকে। তবে একটি আইন বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, স্বামী দাম্পত্য মিলনের আগে স্ত্রীকে তালাক প্রদান করলে স্ত্রী অর্ধেক মোহরানা পাবে। যদি স্বামী দাম্পত্য মিলনের আগেই মারা যায় তাহলে স্ত্রী সম্পূর্ণ মোহরানা পাবে। তবে স্বামী যদি স্ত্রীকে নিয়ে ঘর-সংসার করতে চাইলেও স্ত্রী তার প্রাপ্য দেনমোহর ছেড়ে দেয়ার শর্তে তালাক চায়, সেক্ষেত্রে দেনমোহর পাবে না।এইচএম তানভীর হাসান