ইসলামী পরিভাষায় আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্কের সংরক্ষণকে ‘সেলায়ে-রেহমি’ (আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা) বলা হয়। আর এ সম্পর্ক নষ্ট করলে তাকে বলা হয়Ñ ‘কাতয়ে-রেহমি’ (রেহম ছিন্ন করা)। রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের সঙ্গে আত্মীয়তা রক্ষা করা তথা সেলায়ে-রেহমিকে ইসলাম ওয়াজিব ঘোষণা করেছে। এ সম্পর্ক যত গভীর সে অনুপাতে তা রক্ষা করার তাগিদও ততই বেশি। যেসব পাপ বা গোনাহের শাস্তি আল্লাহ তায়ালা ইহকালেও দেন তার মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করাও অন্যতম।
আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন ‘জুলুমবাজি ও (রক্তের) আত্মীয়তা ছিন্ন করা ছাড়া এমন উপযুক্ত আর কোনো পাপাচার নেই, যার শাস্তি পাপাচারীর জন্য দুনিয়াতেই আল্লাহ অবিলম্বে প্রদান করে থাকেন এবং সেই সঙ্গে আখেরাতের জন্যও জমা করে রাখেন।’ (আহমাদ, তিরমিজি, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ/৪২১১; হাকেম, সহিহুল জামে/৫৭০৪)।
তিনি আরও বলেন ‘আল্লাহর আনুগত্য করা হয় এমন আমলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তাড়াতাড়ি যে আমলের সওয়াব পাওয়া যায় তা হলো, আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখা। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না।
নবী (সা.) বলেনÑ ‘ছিন্নকারী জান্নাতে যাবে না’। সুফিয়ান বলেন ‘অর্থাৎ (রক্ত সম্পর্কীয়) আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী।’ (বোখারি-৫৯৮৪; মুসলিম-২৫৫৬, তিরমিজি)।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, এটি কোনো আচারসর্বস্ব ধর্ম নয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসলাম দিয়েছে সঠিক দিকনির্দেশনা। সামাজিক সম্পর্ক ও সামাজিক রীতিনীতির ক্ষেত্রেও ইসলাম খুবই সুন্দর ও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। ইসলাম সমাজের ব্যক্তিদের পারস্পরিক সম্পর্ককে দুটি ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। একটি হচ্ছে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক। এ সম্পর্ক বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে অত্যন্ত দৃঢ় ও অবিচ্ছিন্ন বন্ধনের কাজ করে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে অধিকার ও মান-মর্যাদা সংরক্ষণ। এর মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তির রক্ত, মান-সম্মান ও ধন-সম্পদের নিরাপত্তা সংরক্ষিত হয়। যেসব কথা, ব্যবহার, আচরণ বা কাজ এ ভিত্তিদ্বয়কে ক্ষুণœ বা ক্ষতিগ্রস্ত করে তা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন ‘এবং ভয় করো আল্লাহকে, যাঁর দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছে নিজের হক বা অধিকারের দাবি করো। আর নিকটাত্মীয়তার সম্পর্ককেও ভয় করো (রক্ষা করো)। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমাদের পর্যবেক্ষণে রত।’ (সূরা আন নিসা : ১)।
মহান আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম হলো রহমান। আর এ শব্দটি রিহমুন মূল ধাতু থেকে উৎপত্তি। এর অর্থ হলো, আত্মীয়তা। সুতরাং যে আত্মীয়তার অধিকার আদায় করে সে যেন আল্লাহর অধিকার আদায় করে। আত্মীয়তার অধিকার সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেনÑ ‘তোমরা তোমাদের আত্মীয়-স্বজনের অধিকার আদায় করো এবং অভাবী ও মুসাফিরদের হক আদায় করো। আর কিছুতেই অপব্যয় করো না।’ (সূরা বনি ইসরাঈল : ২৬)।
অন্য এক আয়াতে বর্ণিত আছে ‘হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো। যিনি তোমাদের এক আত্মা সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন, আর বংশ বৃদ্ধি করেছেন। তাদের দুজন থেকেই অগণিত পুরুষ ও নারী। আর সেই আল্লাহকে ভয় করো। যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছে (স্বীয় হক) দাবি করে থাক এবং আত্মীয়তার হক বিনষ্ট করা থেকে ভয় করো; নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সবারই খবরাখবর রাখেন।’ (সূরা নিসা : ১)।
সূরা রুমের ৩৮নং আয়াতে আল্লাহ বলেন‘হে নবী! আত্মীয়-স্বজনকে তার প্রাপ্য হক দিয়ে দিন এবং মিসকিন ও মুসাফিরদেরও। এটা তাদের জন্য উত্তম, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে। আর তারাই হলো সফলকাম।
অন্য এক হাদিসে নিকটাত্মীয়তার গুরুত্ব এবং আল্লাহ তায়ালার কাছে তার মূল্য বোঝাতে রূপকভাবে বলা হয়েছে ‘রেহম’ রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়তা আকাশের সঙ্গে ঝুলে থেকে বলে যে আমাকে রক্ষা করল আল্লাহও তাকে রক্ষা করবেন আর যে আমাকে ছিন্ন করল আল্লাহও তাকে ছিন্ন করবেন। (বোখারি-মুসলিম)।
আরেক হাদিসে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেন ‘রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয়তা ছিন্নকারী কখনও বেহেশতে যাবে না। শুধু পরকালেই নয়, ‘সেলায়ে-রেহমি’র পুরস্কার ইহকালেও রয়েছে।
হাদিস শরিফে এসেছে, মহানবী (সা.) বলেনÑ যে ব্যক্তি তার রিজিকের প্রাচুর্য এবং দীর্ঘ জীবনের প্রত্যাশা করে, তার উচিত আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা। (মেশকাত)। ‘সেলায়ে-রেহমি’র আরেকটি অবশ্য করণীয় বিষয় হলো, অভাবগ্রস্ত নিকটাত্মীয়কে সাহায্য-সহযোগিতা করা।
এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন ‘কোনো অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে সাহায্য করলে সদকার সওয়াব পাওয়া যাবে। কিন্তু কোনো নিকটাত্মীয়কে সাহায্য করলে একই সঙ্গে সদকা এবং আত্মীয়তার হক আদায়ের দ্বৈত সওয়াব লাভ করা যায়।’ (মেশকাত)।
আল্লাহ তায়ালা বলেনÑ ‘ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে। এদের প্রতি আল্লাহ তায়ালা অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদের বধির ও দৃষ্টি শক্তিহীন করেন।’ (সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩)।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেনÑ ‘যারা আল্লাহ তায়ালাকে দেয়া দৃঢ় অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, যে সম্পর্ক অক্ষুণœ রাখতে আল্লাহ তায়ালা আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে তাদের জন্য রয়েছে লানত ও অভিসম্পাত এবং তাদের জন্যই রয়েছে মন্দ আবাস।’ (সূরা রা’দ : ২৫)।
হজরত আয়েশা (রা.) হজরত মুহাম্মদ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) বলেন ‘রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়তা ঢালস্বরূপ। যে ব্যক্তি এর সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে রাখে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে রাখি। আর যে লোক তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করি।’ (বোখারি শরিফ)।
অন্যত্র এরশাদ হচ্ছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন ‘আত্মীয়তা আল্লাহ তায়ালার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে বিচ্ছিন্ন করা থেকে আপনার কাছে আশ্রয় প্রার্থনার সময় এটা। আল্লাহ তায়ালা বলেন হ্যাঁ, তবে তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখব এবং যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করব? শুনে আত্মীয়তা বলল, অবশ্যই। তখন আল্লাহ তায়ালা বললেন তোমার জন্য এরূপই করা হবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
সেজন্যই আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার প্রতি সবার মনোযোগী হতে হবে। পরপর অবস্থান ও সামর্থ্যরে মধ্যে এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। সাধারণ রেষারেষি, প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান কিংবা জেদের বশবর্তী হয়ে এ সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না, মলিন হতে দেয়া যাবে না। দেখা-সাক্ষাৎ, যোগাযোগ, খোঁজখবর বজায় রাখার মধ্য দিয়ে এ সম্পর্ক উজ্জ্বল করে তুলতে হবে। আত্মীয়ের অসহায়ত্ব এবং নিজের সামর্থ্যরে সমন্বয় করে প্রয়োজনে সাহায্য নিয়ে আত্মীয়ের পাশে দাঁড়াতে হবে। আমাদের পরস্পরের হৃদ্যতা ও সুখ-দুঃখে আত্মীয়দের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতাই পারে এ অস্বস্তিকর সামাজিক অবক্ষয় থেকে মুক্তি দিতে। আত্মীয়তা সম্পর্ক রক্ষাকারী পরকালীন প্রতিদান পাওয়ার পাশাপাশি দুনিয়াতেও এর সুফল লাভ করবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার