আল্লাহ্র রাসূলের (সা.) প্রতিটি ভাষণই অতুলনীয়। কেননা এ ভাষণগুলো মানবজাতির হেদায়েতের জন্য তিনি প্রদান করেছেন বারবার। এখানে তিনি শুধু একটি উম্মাহ্র জন্যই এগুলো বলেছেন তা নয়; অবশ্যই তাঁকে পাঠানো হয়েছে পৃথিবীর মানুষের কল্যাণের জন্য। তিনি তাঁর কথা-বার্তা, কাজের মাধ্যমে মানুষকে সরল পথের দিকে আহ্বান করেছেন। এ কারণে প্রতিটি ক্ষণে প্রতীয়মান হয়- তিনি মানবতার প্রকৃত বন্ধু। আজ আমরা তাঁর এমন একটি খুতবা পেশ করছি, যা থেকে প্রতীয়মান হবে কীভাবে হিদায়াতপ্রাপ্ত হওয়া যাবে আর কীভাবে পথভ্রষ্টতার দিকে মানুষ ধাবিত হয়। অর্থাৎ হিদায়াত ও পথভ্রষ্টতার একটা মাপকাঠি আজকের আলোচ্য বিষয়। জুমাবারে এগুলো বেশি-বেশি বয়ান হওয়া প্রয়োজন। এই সম্ভাবনার জায়গা থেকেই আমাদের এই ধারাবাহিক আয়োজন। আজকের ভাষণটি বর্ণিত হয়েছে আবু দাউদ ও তিরমিজি শরীফে। আব্দুল কাইয়ুম নাদভী এটি নকল করেছেন।
আল্লাহ্র প্রশংসা ও প্রশস্তি বর্ণনার পর রাসূল (সা.) বলেন, নিশ্চিতভাবে দুনিয়া একটি সবুজ সতেজ ও মিষ্ট বস্তু। অদূর ভবিষ্যতে আল্লাহ্ তায়ালা তোমাদের আপন খলিফা বানাবেন। অতঃপর দেখবে, তোমরা কিরূপ আমল কর। অতএব তোমরা দুনিয়া ও নারী সম্পর্কে সাবধান থাকবে। কিয়ামতের দিন প্রত্যেক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীর, তার অঙ্গীকার ভঙ্গের সম-পরিমাণ একটি পতাকা থাকবে। আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী রাষ্ট্রনায়কের, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের চাইতে জঘন্য আর কিছু হবে না। তার পতাকা তার কটিদেশ বা কোমরের কাছে (নিচু) থাকবে। মানুষের ভয় তোমাদের কাউকে যেন সত্য কথা বলা থেকে বিরত না রাখে। বিভিন্ন স্তরের মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মু’মিনরূপে জন্মগ্রহণ করে মু’মিনরূপে জীবন অতিবাহিত করে এবং মু’মিনরূপেই মৃত্যু বরণ করে। আবার কেউ কেউ কাফিররূপে জন্মগ্রহণ করে কাফিররূপে জীবন অতিবাহিত করে এবং মু’মিনরূপে মৃত্যুবরণ করে।
অতঃপর তিনি ক্রোধ সম্পর্কে বলেন, কিছু লোক এমন আছে, যারা খুব তাড়াতাড়ি ক্রোধান্বিত হয় আবার তাড়াতাড়ি তাদের ক্রোধ প্রশমিত হয়ে যায়। এই গুণ বা অবস্থা একটি অপরটির বিপরীত অর্থাৎ(সমান্তরাল)।
কিছু লোক এমন আছে, যারা দেরিতে ক্রোধান্বিত হয় এবং দেরিতে তাদের ক্রোধ প্রশমিত হয়। এই অবস্থাও সমান্তরাল। তোমাদের মধ্যে ওরা হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম লোক, যারা দেরিতে ক্রোধান্বিত হয় কিন্তু শিগগিরই তাদের ক্রোধ প্রশমিত হয়ে যায়। নিকৃষ্টতম লোক হচ্ছে ওরা, যারা তাড়াতাড়ি ক্রোধান্বিত হয় কিন্তু তাদের ক্রোধ প্রশমিত হয় দেরিতে। নবীজী (সা.) বলেন, তোমরা ক্রোধ থেকে নিজেদের রক্ষা কর, এটা মানুষের অন্তরে একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ স্বরূপ। তোমরা কি দেখ না, যখন মানুষ ক্রোধান্বিত হয়, তখন তার চক্ষুযুগল রক্ত-রং ধারণ করে, এবং তার ঘাড়ের শিরা ফুলে ওঠে। অতএব যখন কারোর রাগ হয়, তখন সে যেন সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়ে।
অতঃপর তিনি(সা.) ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে বলেন, তোমাদের মধ্যে কিছু এমন লোক রয়েছে, সুষ্ঠুভাবে যারা নিজেদের ঋণ পরিশোধ করে। তবে তাদের কাছে কেউ ঋণী হলে সেই ঋণের তাগাদায় কঠোরতা অবলম্বন করে। এক্ষেত্রে প্রথম গুণ হচ্ছে দ্বিতীয় গুণের বিনিময়, (অর্থাৎ এখানে প্রশংসা পাবার কিছু নেই)। তাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম যে কারোর কাছে ঋণী হলে সুষ্ঠুভাবে পরিশোধ করে। কিন্তু কেউ, তার কাছে ঋণী হলে সে ঋণের তাগাদায় অত্যন্ত নম্রতা অবলম্বন করে। আর তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই হচ্ছে নিকৃষ্টতম যে ঋণ আদায়ে হয় কঠোরতর।(তিরমিজি শরীফ)
এই খুতবার সারবত্তায় মুহাদ্দিস বা হাদিস-বিশারদগণের বক্তব্য হচ্ছে, এখানে প্রতিফলিত হয়েছে প্রশাসনিক আইন-কানুন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার রীতি-নীত। সময়ের দাবি অনুযায়ী এটির গুরুত্ব অত্যধিক। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা প্রত্যেকে আল্লাহ্র খলিফা বা প্রতিনিধি। যারা এই বিশ্বাসে স্থির মুসলিম তাদের অবশ্যই কর্তব্য হচ্ছে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তারা প্রত্যেকটি ব্যক্তি এবং প্রত্যেকটি সৃষ্টির উপকার সাধন করবে। প্রত্যেকের কাজে হচ্ছে, দুনিয়ার সেবা করা-দুনিয়া অর্জন করা নয়। দুনিয়ার প্রতি লোভ-লালসা, নারীদের প্রতি আসক্তি এই মর্যাদাকে বিনষ্ট করে দেয়, আর এটার উদাহরণ মধু আর সিরকার মতো। মধুকে যেমনভাবে সিরকার নষ্ট করে দিতে পারে। প্রায়শ ইতিহাসের এ উদাহরণ ইতিহাসের আলোকে পেশ করা হয়েছে যতক্ষণ মুসলমানরা রাসূলের (সা.) মূল্যবান উপদেশসমূহ মেনে চলেছে, তত সময় অবধি দুনিয়া তাদের পিছনে ছুটেছে। যখন তারা রাসূলের (সা.) বাণীনিচয় বিস্মৃত হয়েছে তখনই ঘটেছে বিপর্যয়। আর প্রত্যেকে পরিণত হয়েছে দুনিয়ার দাসে।
প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই আপনারা লক্ষ্য করেছেন— এই হাদিসে যাপিত জীবনের জন্য কতগুলো ব্যাপারে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে। ঈমান, কুফর, ক্রোধ, সংযম এবং ঋণ পরিশোধ ও ঋণ আদায়ের প্রকৃত পদ্ধতির আলোকে মানুষের মনুষ্যত্ব সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে। পথভ্রষ্টতা যাতে আমাদের নষ্ট মানুষে পরিণত না করে সে জন্য সতর্ক করা হয়েছে। একইভাবে বান্দাহ্র সাথে সৃষ্টিকর্তার সম্পর্ক নিবিড় করার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং এই হাদিস থেকে আমাদের শিক্ষণীয় হল— মুসলমান হিসাবে জন্মগ্রহণ করে আবার প্রকৃত মুসলমানরূপেই মৃত্যু বরণ করতে হবে। ব্যবহারিক জীবনের প্রত্যেক পর্বে ক্রোধকে সংবরণ করা ও ঋণ পরিশোধে তাড়া থাকতে হবে। আমরা কেউই জানি না কখন আমাদের জীবন প্রদীপ নিভে যাবে!
এ. কে. এম. মহিউদ্দীন :
লেখক : প্রাবন্ধিক, পিএইচডি গবেষক