কুরআন পাঠের ফজিলত

‘স্মরণ করুন! আমি আপনার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জীনকে, যারা কুরআন পাঠ শুনছিল, যখন তারা তাঁর নিকট উপস্থিত হলো, তারা একে অপরকে বলতে লাগল, চুপ করে শ্রবণ কর। যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হলো তারা তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল সতর্ককারী রূপে। ওরা বলেছিল, হে আমাদের সম্প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শ্রবণ করছি, যা অবতীর্ণ হয়েছে মূসার ওপরে, এটা তার পূর্ববর্তী কিতাবকে সমর্থন করে এবং সত্য ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। হে আমাদের সম্প্রদায়! আল্লাহ্‌র দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তার প্রতি ঈমান গ্রহণ কর, আল্লাহ্‌ তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন এবং মর্মপীড়াদায়ক শাস্তি থেকে তোমাদের রক্ষা করবেন। কেউ যদি আল্লাহ্‌র দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া না দেয় তবে সে পৃথিবীতে আল্লাহ্‌র অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে পারবে না এবং আল্লাহ্‌ ব্যতীত তাদের কোনো সাহায্যকারী থাকবে না। ওরা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।’ —সূরা আহকাফ, আয়াত : ২৯-৩২ মানুষেরা আজ দিশাহীন যাত্রী। গন্তব্য কোথায় তার, সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। মতবাদের দালালী করতে গিয়ে সে খেই হারিয়ে ফেলেছে। তার হওয়ার কথা ছিল কী, আর হয়েছে কী। মানুষের সেই বুঝ ঠিক সময়ে দেওয়ার জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূলদের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়েছে কিতাবসমূহ। সেই ধারাবাহিকতায় নবীজী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এঁর ওপর নাজীল করা হয়েছে আল-কুরআন। কুরআনের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন যাতে না ওঠে এ কারণে এ সংক্রান্ত এলেমও ধারাবাহিকভাবে অর্জন করেছে বিশেষজ্ঞগণ। আর সেই জ্ঞান প্রচার করা হয়েছে জনে জনে। এই জ্ঞানের নাম ‘উলুমুল কুরআন’। কুরআনের জ্ঞান। এটি থাকলে কুরআন বুঝা সকলের জন্য সহজ হয়ে যায়। বাজারে এ সংক্রান্ত কিতাবগুলো এমন জটিল যে, অন্ধের জাও খাওয়ার মতো অবস্থা! অন্ধের কাছে এক ব্যক্তি বলছে— ভাই, তুমি কি জাও (ক্ষীর) খাবে নাকি? অন্ধ বলল, জাও কী রকম? উত্তর দেওয়া হলো— শাদা। শাদা কী রকম, বলা হলো— দুধের মতো। দুধ কী রকম? বলা হলো— বকের মতো। বক কী রকম? তখন আহ্বানকারী বলল, বক হলো কাচির মতো। কাচি কী রকম? এ প্রশ্নের উত্তরে ভঙ্গি করে হাত বাঁকিয়ে দেখানো হলো— ঐ দেশী অস্ত্রটি কেমন। অন্ধ হাত স্পর্শ করে শাদার যে আন্দাজ সে করল, তাতে সে বলল, এমন অস্ত্রের মতো জাও যখন,ভাই আমি এটা খাব না। এভাবেই জটিলতার কারণে অন্ধের আর জাও খাওয়া হলো না। আজ আমাদের অবস্থাটাও হয়েছে অনুরূপ। ফলে কুরআনের প্রকৃত জ্ঞান বিতরণ না করতে পারার কারণে মানুষেরা কুরআন পাঠ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ কারণে আমরা আকাঙ্ক্ষা করেছি সহজে উলুমুল কুরআন পাঠের সহায়ক জ্ঞান সরলভাবে এই বিভাগে বর্ণনা দিয়ে যেতে চাই। আসুন আমরা সবাই মিলে বিষয়টি পর্যালোচনা করি। কুরআন পাঠে লাভ-ক্ষতি কেমন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যে ব্যক্তির শরণ নিচ্ছি তিনি হলেন আল্লামা এহতেশামুল হক থানভী (রহঃ)। তিনি তার ‘কুরআন এক বিপ্লবের কর্মসূচি’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় ইমাম রাজী (রহঃ)-এঁর উদ্ধৃতি দেন। ইমাম রাজী (রহঃ) বলেছেন, সকল আসমানী কিতাবের সার-নির্যাস হলো কুরআন, আর কুরআনের সার-নির্যাস হলো সূরা আল ফাতিহা। সূরা ফাতিহার সার-নির্যাস হলো বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম। আর বিসমিল্লাহ্‌র নির্যাস হলো তার প্রথম অক্ষর ‘বা’। ‘বা’-এর অর্থ হলো কোনো জিনিস মিলিয়ে দেওয়া, ভাঙ্গা জিনিস জোড়া দেওয়া। পৃথিবীতে আল্লাহ রাব্বূল আলামীন যে কয়টি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন —এর সবগুলোরই উদ্দেশ্য হলো হিদায়াৎ-বিচ্ছিন্ন মানুষকে আল্লাহ্‌র পথে জুড়ে দেওয়া। বর্তমান বিশ্বে মানুষ শান্তির অন্বেষায় বিভোর হয়ে ঘুরছে। নানা-রকম অশান্তি, ফিৎনা-ফাসাদ তাদের ঘিরে ধরেছে। হাদীস শরীফে রয়েছে, এমন এক সময় আসবে যখন মুসলমানরা নানা রকম ফিৎনা-ফাসাদের পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) নবীজীকে (সাঃ) জিজ্ঞাসা করেছিলেন সে সব ফিৎনা থেকে কীভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে? নবীজী (সাঃ) বললেন, আল্লাহ্‌র কিতাবের মাধ্যমে সে সব থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। পৃথিবীর কোনো গ্রন্থ কুরআনের মতো মধুর সুরে পাঠ করা যায় না। কিন্তু এই কুরআন আসলে কী? আমরা কীভাবে তা থেকে উপকার লাভ করতে পারি? বিগত চৌদ্দ-শতাধিক বছরে আমরা কুরআন থেকে কীরূপ কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হয়েছি? এ সব প্রশ্ন যথাযথভাবে আমাদের অনুধাবন করতে হবে। প্রশ্ন হলো ওহীর প্রয়োজন কী? বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে মানুষ কি নিজের বুদ্ধি-বিবেক দ্বারা জীবনের পথ নির্ধারণ করতে পারে? —না পারে না। মানুষ সব কিছু পারে না। আপন স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে তারা সঠিক কিছু বলতে পারে না। মানুষ আলো তৈরী করতে পারে, যে আলো দ্বারা অন্ধকার দূর করতে পারে কিন্তু তার মনের অন্ধকার দূর করার মতো একমাত্র নবী (আঃ)-দের কাছেই থাকে। সেই আলো আল্লাহ্‌র প্রদত্ত। বিবেক বুদ্ধি দ্বারা আল্লাহ্‌র ইচ্ছা জানা তো দূরে থাক মানুষ অন্য মানুষের মনের কথাও তো বলতে পারে না। এ বিশ্ব জগৎ আল্লাহ্ তায়ালা কেন সৃষ্টি করেছেন। এর পেছনে আল্লাহ্‌র কী উদ্দেশ্য রয়েছে, সেটাও আল্লাহ্‌রই বলে দেওয়া তথ্যের দ্বারাই মানুষ জানতে পারে। আল্লাহ্‌ তায়ালা সে সব তথ্য সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করার উদ্দেশ্যেই নবী (আঃ)-দের ওপর কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এঁর ওপর কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে এবং এর সমাপ্তির দ্বারা আসমানী কিতাব তথা ওহী অবতরণ সমাপ্ত করা হয়েছে। হজরত আদম (আঃ)-এঁর ওপর আল্লাহ্‌ তায়ালা যে সহীফা অবতীর্ণ করেছিলেন তাতে কাঠ এবং লোহার ব্যবহার সম্পর্কে তাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য নবী (আঃ)-এঁর কাছে প্রেরিত ওহীর মাধ্যমে আল্লাহ্‌ তায়ালা মানুষের জন্য তাঁর মনোনীত জীবন বিধানের পূর্ণতা দান করেন। মানুষের ব্যবহারিক ও বস্তুজীবনের নানাপ্রকার শিক্ষাও কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। কুরআনে আল্লাহ্‌ তায়ালা যা বলেছেন পৃথিবীর সকল দার্শনিক ঐক্যবদ্ধ হলেও কোনো একটি শব্দ মিথ্যা প্রমাণ করতে পারবে না। মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব (রহঃ) বলেছেন কুরআনুল হাকীম মানুষকে সবকিছু থেকে ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়। কুরআনুল করীম সকল বিষয়ে মানুষকে পরমুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্ত-স্বাধীন করে দেয়। অনেকে বলে কুরআন মজীদের জন্য ‘অনেক জ্ঞান দরকার’। আমি বলব— জ্ঞান তেমন না থাকলেও চলবে। হজরত মুজাদ্দীদে আলফ সানী (রঃ) বলেছেন, এ পথে নাদানী ও মূর্খতা বেশি কার্যকরী। এই ইলম অর্জনের জন্য বিশেষ নিয়ম আছে। নিয়মের অধীনেই জ্ঞান চর্চা হয়। কুরআন শরীফ আজ প্রত্যেকের বাড়িতে পাওয়া যায়। কিন্তু পাওয়া যায় না এর মর্ম বোঝা মানুষগুলোকে। এটা এমন একটা জিনিসে রূপ নিয়েছে যেন কারো কাছে রাখা একটা আয়নার উদাহরণ। একজনের কাছে এই আয়নাটা রয়েছে বহুকাল। কিন্তু সে উল্টিয়ে দেখে ফলে সে কিছুই দেখতে পায় না। বুজুর্গানে দ্বীন সাধ্যমতো চেষ্টা করে চলেছেন। কঠিন বাধ্যবাধকতার কথা বলে আসছেন। লোভনীয়-মোহময় ও আকর্ষণীয় বস্তুসমূহ ত্যাগ করে চলেছেন। আল্লাহ্‌র পিয়ারা নবী-রাসূলগণ তো শুধু সাধনা নয় বরং বাস্তবে দেখিয়ে দিতেন। তারা শুধু বলতেন— আয়নাটি সোজা করে দেখ, সবই তোমার চোখের সামনে প্রতিভাত হবে। —“হে মু’মীনগণ, তোমরা আল্লাহ্‌র ব্যাপারে সাবধান থাক, এবং আগামী দিনের (পরকালের) জন্য কী পাঠিয়ে চলেছে প্রতিটি প্রাণী যেন তার প্রতি খেয়াল রাখে” এটাই হলো আয়না সোজা করে দেখা।
Share this article :
 
Helped By : WWW.KASPERWINDOW.TK | KasperWindowTemplate | Download This Template
Copyright © 2011. আমার কথা ঘর - All Rights Reserved
Template Created by Aehtasham Aumee Published by KasperWindow
Proudly powered by Blogger