
নারী-পুরুষ মিলেই মানবজাতি। নারী ও পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। নারীরা কেউ অবহেলিত নয়, তুচ্ছও নয়। মহান আল্লাহ একথা কোরআনুল কারিমে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘তাদেরও তেমনি অধিকার আছে, যেমন তোমাদের আছে তাদের ওপর।’ (সূরা বাকারা : ২২৮)।
কিন্তু যুগে যুগে নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন সমাজে, বিভিন্ন ধর্মে নারীর প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে। ইতিহাসের বিভিন্ন অধ্যায়ে নারী হয়েছে নির্যাতিত ও নিপীড়িত। বিশ্বনবী (সা.) এর আবির্ভাবকালে নারী ছিল চরম অবজ্ঞার শিকার। তারা ছিল অধিকারবঞ্চিত।
ইসলাম হচ্ছে মানবতার মুক্তির সনদ। ইসলাম সর্বক্ষেত্রে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলাম নারীকে মাতা, কন্যা ও স্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছে। মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষের দৈহিক গঠন একই হলেও নারী-পুরুষ প্রত্যেকেরই আকৃতি ও প্রকৃতিতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এজন্য সর্বক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও কর্মক্ষেত্র এক নয়। তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীও নয়, বরং সহযোগী। কেবল ইসলাম ধর্মই নারীর এই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।
উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মক্কা বিজয়ের পর একদিন রাসূল (সা.) ফাতেমাকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে চুপি চুপি কিছু কথা বলেন, তা শুনে ফাতেমা কেঁদে ফেললেন। অতঃপর পুনরায় তিনি তার সঙ্গে কথা বলেন। এবার ফাতেমা হেসে উঠলেন। রাসূল (সা.) এর ইন্তেকালের পর আমি তাকে কাঁদার ও হাসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেন, অচিরেই তিনি ইন্তেকাল করবেন তা শুনে আমি কেঁদে ছিলাম। তারপর তিনি আমাকে বললেন, ঈসা (আ.) এর মা মরিয়ম ব্যতীত জান্নাতের সব নারীর সরদার আমি হব। (তিরমিজি)
এই হাদিসই নারীদের প্রতি নবী (সা.) এর সহানুভূতির কথা প্রকাশ করে। কেননা, তিনি তার কন্যাকে কন্যা হিসেবে মর্যাদা দিয়েই তো একথা বলেছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, গোটা দুনিয়াটাই সম্পদ। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো সতীসাধ্বী নারী (বোখারি)।
এই হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয়, ইসলাম নারীকে কতটা অধিকার দিয়েছে। ইসলামের প্রাক্কালে আরবরা নারীদের মোটেই সম্মান করত না। তারা ভাবত নারী এক অপদার্থ জাতি। তাই কন্যাসন্তান জন্ম নিলে তাকে জীবন্ত প্রোথিত করত। মহান আল্লাহ কন্যাদের প্রোথিতকরণ সম্পর্কে বলেনÑ জীবন্ত প্রোথিত কন্যা সন্তানকে কেয়ামতের দিন জিজ্ঞেস করা হবে কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।
কোরআন মাজিদে পুরুষের মতো নারীদের অধিকারের কথা বর্ণনা করে মহান আল্লাহ নির্দেশ করেন, আল্লাহ তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে বিশেষ অর্থনৈতিক বিধান দিচ্ছেন, তিনি আদেশ করেছেন একজন পুরুষ দুজন মেয়ের সমান অংশ পাবে। কেবল মেয়ে সন্তান দুজন কিংবা ততোধিক হলে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। আর যদি একজন কন্যা হয় তাহলে সে মোট সম্পত্তির অর্ধেক পাবে।’ (নিসা : ১১)।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি দুটি কন্যাকে বিয়েশাদি দেয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে আমি ও সেই ব্যক্তি কেয়ামতের দিন একসঙ্গে থাকব। এই বলে নিজের অঙ্গুলিগুলো মিলিয়ে ধরলেন। (মুসলিম)
এই হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, ইসলাম কন্যা হিসেবে নারীকে কতটা অধিকার দিয়েছে। ইসলামপূর্ব সমাজে নারীরা স্ত্রী হিসেবেও কোনো মর্যাদা পেত না। চরম অপমান ও অমর্যাদা তাদের সহ্য করতে হতো। স্বামীর কাছেও তাদের কোনো মর্যাদা ও অধিকার ছিল না।
তাদের সঙ্গে দাসী-বাঁদির মতো জঘন্য আচরণ করা হতো। ইসলামই নারীকে স্ত্রী হিসেবে যথাযোগ্য সম্মান দিয়েছে। সমাজে তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য নারীকে পুরুষের সমান বলে আল্লাহ কোরআন মাজিদে ঘোষণা করেছেন। নারী ও পুরুষ উভয়ে সমান; মৌলিক অধিকারে কোনো পার্থক্য নেই। জাহেলি যুগে নারীদের অবহেলার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হতো।
নবী (সা.) তার ঐতিহাসিক ভাষণে নারী সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন এবং বলেন, তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ আল্লাহর জামানতে এবং আল্লাহর নির্দেশে তাদের হালাল করেছ। তাদের ওপর তোমাদের হক হলো তারা যেন তোমাদের মহলে কাউকে যেতে না দেয়, যা তোমরা অপছন্দ কর। আর তোমাদের ওপর তাদের হক হলো তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করবে। অত্র হাদিস দ্বারা বোঝা যায়, স্ত্রীর সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতে হবে।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সা.) এর কাছে আরজ করল, হে রাসূল (সা.) আমার কাছে সর্বোচ্চ সৌজন্যমূলক আচরণ পাওয়ার অধিকারী কে? উত্তরে তিনি বললেন, তোমার মা। সে আবার জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে আবার জিজ্ঞেস করল? তারপর বললেন তোমার পিতা। এই হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, সন্তানের কাছে মায়ের অধিকার পিতার চেয়ে অনেক বেশি। পিতার চেয়ে মায়ের অধিকার বেশি হওয়ার তিনটি কারণ রয়েছেÑ প্রথমত, ১০ মাস যাবৎ মা তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে অপরিসীম কষ্ট করে থাকেন।
দ্বিতীয়ত, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রসব করেন। তৃতীয়ত, দুগ্ধপান থেকে শুরু করে প্রায় ১০ বছরে উপনীত হওয়া পর্যন্ত মা নিজের আরামকে হারাম করে সন্তানদের লালন-পালন করেন। যা অন্য কিছুর সঙ্গে তুলনীয় নয়। মাকে সম্মান দিলে তার গন্তব্য জান্নাত। নবী (সা.) বলেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। (তিরমিজি)।
