যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে আনন্দ উপভোগ করে একদিন তার চোখে অশ্রু আসবে এবং যে ব্যক্তি দুনিয়া থেকে আরাম-আয়েশ লাভ করে একদিন তার জীবনে অভাব-অনটন ও দুর্যোগ নেমে আসবে। কেউ আরামের হালকা বৃষ্টি পেলে দুর্দশার প্রবল বৃষ্টি তার ওপর পতিত হবে। এ দুনিয়ার স্বভাব এমনই যে, সকাল বেলায় যাকে সমর্থন করে বিকেল বেলায় তাকে আর চেনে না। যদি এর একদিক মধুর ও মনোরম হয় তবে অন্যদিক কটু ও বেদনাদায়ক।
দুনিয়ার চাকচিক্য থেকে কেউ উপভোগ্য সংগ্রহ করলে তাকে এর দুর্যোগের দুর্দশাও মোকাবেলা করতে হয়। যে ব্যক্তি নিরাপত্তার পাখাতলে সন্ধ্যাবেলা অতিবাহিত করবে সকালবেলায় সে আতঙ্কের পাখার অগ্রভাগের পালকের নিচে থাকবে। দুনিয়া ছলনাময়ী এবং এতে যা কিছু আছে সবই ছলনা মাত্র। এটা নশ্বর এবং এতে যা কিছু আছে সবই লয়প্রাপ্ত হবে। এর ভাণ্ডারে কল্যাণকর কোনো রসদ নেই একমাত্র তাকওয়া ছাড়া। যে দুনিয়া থেকে স্বল্পমাত্রায় গ্রহণ করে সে অনেক কিছু সঞ্চয় করে যা (পরকালে) তাকে নিরাপত্তা প্রদান করবে এবং যে এটা থেকে প্রভূত পরিমাণ গ্রহণ করে সে মূলত তাই গ্রহণ করল যা তাকে ধ্বংস করবে। তার সংগ্রহসমূহ ছেড়ে সে অচিরেই প্রস্থান করবে। কত লোক দুনিয়ার ওপর নির্ভর করেছিল কিন্তু দুনিয়া তাদেরকে দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত করেছিল, কত লোক এতে শান্তি অনুভব করেছিল, ফলে তাদের অধঃপতন হয়েছিল; কত লোক (দুনিয়ার সংগ্রহ দ্বারা) মর্যাদাকর অবস্থায় ছিল কিন্তু তা তাদের হীনাবস্থায় ফেলেছে এবং কত লোক (দুনিয়ার সংগ্রহের জন্য) গর্বিত ছিল কিন্তু তা তাদেরকে অসম্মানজনক অবস্থায় ফেলেছিল।
দুনিয়ার কর্তৃত্ব পরিবর্তনশীল। এর জীবন নোংরা। এর মধুর পানিও কটুস্বাদযুক্ত। এর মধুরতা গন্ধরসের মতো। এর খাদ্য দ্রব্য বিষযুক্ত। এর উপকরণাদি দুর্বল। এতে বেঁচে থাকা মৃত্যুতুল্য; এতে স্বাস্থ্যবানও রুগ্ণতুল্য। এর রাজত্ব কেড়ে নেওয়া হবে। এর শক্তিধরগণ পরাজিত হবে এবং ধনবানগণ দুর্ভাগ্য দ্বারা আক্রান্ত হবে। এর প্রতিবেশীরা লুটেরা হবে। তোমরা কি তোমাদের পূর্ববর্তীদের ঘরে বসবাস কর না? তারা তোমাদের চেয়ে দীর্ঘজীবী ছিল, তোমাদের চেয়ে বেশী অনুসন্ধানী ছিল, তোমাদের চেয়ে বেশী আকাঙ্ক্ষী ছিল, তোমাদের চেয়ে সংখ্যায় বেশী ছিল এবং তাদের বিশাল সৈন্যবাহিনী ছিল। তোমরা কি দেখনি কীভাবে তারা (দুনিয়ার প্রতি) নিজেদেরকে আসক্ত করেছিল এবং কীভাবে তারা (দুনিয়াকে) সব কিছুর ঊর্ধ্ব মনে করত? এরপর সব কিছু পরিত্যাগ করে তাদের চলে যেতে হয়েছিল এবং আখিরাতের পথ অতিক্রম করার জন্য তাদের না ছিল কোনো রসদ, না ছিল কোনো বাহন।
তোমরা কি এ সংবাদ পাওনি যে, তাদের জন্য যে-কোনো মুক্তিপণ দিতে দুনিয়া উদার ছিল অথবা যে-কোনো সমর্থন বা উত্তম সঙ্গী দিতে চেয়েছিল? কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয়নি। বরং দুনিয়া তাদের বিপদাপন্ন করেছে, দুর্যোগ এনে তাদেরকে অসাড় করে দিয়েছে, আকস্মিক বিপর্যয় দ্বারা তাদের নিগৃহীত করেছে, তাদের ধাক্কা মেরে উপুড় করে ফেলে দিয়েছে, খুরের নিচে দলিত মোথিত করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে সময়ের উত্থান-পতনের সহায়তা করেছে। তোমরা নিশ্চয়ই তাদের প্রতি দুনিয়ার অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করেছ যারা এর কাছে গিয়েছিল, অর্জন করেছিল, উপযোজন করেছিল এবং চিরতরে এটা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। দুনিয়া কি তাদেরকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা ছাড়া অন্য কোনো রসদ দিয়েছিল? এটা কি তাদেরকে সংকীর্ণ স্থান ছাড়া অন্যকোনো বাসস্থান দিয়েছিল। এটা কি তাদেরকে অন্ধকার ছাড়া আলো এবং অনুশোচনা ছাড়া অন্য কিছু দিতে পেরেছিল? এটাই কি সেটা নয় যা তোমরা বেশী বেশী পেতে চাও, যাতে তোমরা সন্তুষ্ট থাকো এবং যার প্রতি তোমরা লোভাতুর থাকো? কত নিকৃষ্ট এ আবাসস্থল যা তার অনুমান করতে পারেনি এবং ওটা থেকে তাদের ভয়ের উদ্রেক হয়নি? মনে রেখো, দুনিয়াকে পরিত্যাগ করে তোমাদেরকে চলে যেতেই হবে। তোমরা তদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর “যারা বলতো আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে” (কুরআন- ৪১ : ১৫)
তাদেরকে কবরে নেওয়া হয়েছিল কিন্তু সওয়ার হিসাবে নয়। তাদেরকে কবরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু মেহমান হিসাবে নয়। তাদের কবর মাটিতেই হয়েছিল। তাদের কাফন কাপড়েরই ছিল। পুরাতন হাড় তাদের প্রতিবেশী হয়েছিল। এটা এমন প্রতিবেশী যা আহ্বানে সাড়া দেয় না, বিপদে সাহায্য করে না এবং কাঁদলে ফিরেও তাকায় না। বৃষ্টি হলে তারা (কবরবাসী) আনন্দ অনুভব করে না এবং দুর্ভিক্ষে তারা হতাশ হয় না। তারা একত্রিত কিন্তু একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ করে না। তারা সহিষ্ণু এবং কারো প্রতি তাদের কোনো ঘৃণাবোধ নেই।
তারা অজ্ঞ এবং তাদের দ্বারা কারো ক্ষতির সম্ভাবনা মরে গেছে। তাদের কাছ থেকে বিপদের কোনো আশঙ্কা নেই এবং বিপদে তারা সাহায্য করতে পারবে এমন আশাও নেই। তারা পৃথিবীর পিঠকে (উপরিভাগ) পেটের (অভ্যন্তরভাগ) সাথে, বিশালতাকে সংকীর্ণতার সাথে, পরিজনকে (বেষ্টিত অবস্থা) একাকীত্বের সাথে এবং অন্ধকারকে আলোর সাথে বিনিময় করে নিয়েছে। তারা যেভাবে এ পৃথিবীতে এসেছিল সেভাবেই খালি পায়ে ও নিরাবরণ শরীরে চলে গেছে। তারা তাদের স্থায়ী জীবন ও আবাসে শুধুমাত্র তাদের আমলনিয়ে গেছে। আল্লাহ্ বলেন, ‘যেভাবে আমরা প্রথম সৃষ্টি করেছিলাম সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব; (এটা এমন) এক ওয়াদা যা পূর্ণ করার দায়িত্ব আমাদের, অবশ্যই আমরা তা করব।’ (কুরআন-২১ : ১০৪)